আরাকান আর্মি কর্তৃক বাংলাদেশী ১০ জেলে অপহরণ প্রসঙ্গে

আরাকান আর্মি কর্তৃক বাংলাদেশী ১০ জেলে অপহরণ প্রসঙ্গে
দেশের সীমানার মধ্যে নাফ নদীতে মাছ শিকাররত অবস্থায় ১০জন বাংলাদেশী জেলেকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত আরাকান আর্মি অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার অতি উদ্বেগজনক খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গত বুধবার সকালে উখিয়ার পালংখালীতে এ অপহরণের ঘটনা ঘটায় অপহৃতদের স্বজন তথা কক্সবাজারবাসী অতি উদ্বেগ উৎকন্ঠায় আছেন। পালংখালীর ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি বিষয়টি  প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

সম্প্রতি আরাকান আর্মির সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মিয়ানমারের সেনা সদস্য, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যসহ ৩৩০ জন বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার তাদের  আশ্রয় দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। আহত ও অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। পোষাকের ব্যবস্থা করেছে। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে এবং দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের কাছে তাদের নিরাপদে হস্তান্তর করেছে। মিয়ানমার সমুদ্র পথে জাহাজে করে তাদের সেনাসদস্য, সীমান্তরক্ষী বিজিপির সদস্য, সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের স্বদেশে নিয়ে গেছে। পরে আরেক দফায় মিয়ানমার থেকে আরাকান আর্মির সাথে যুদ্ধে টিকে থাকতে না পেরে প্রাণ রক্ষার জন্য সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আরো ২৮৮ জন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় প্রার্থনা করলে বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে। এবারও দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের মাধ্যমে মিয়ানমারের পালিয়ে আসা আশ্রয় পাওয়া সেনাসদস্য,বিজিপি সদস্যদের মিয়ানমার জাহাজে করে ফিরিয়ে নিয়েছে। এবার মিয়ানমারের কারাগারে থাকা ১৭৩ জন বাংলাদেশী নাগরিককে জাহাজে করে এনে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। বাংলাদেশ সরকার সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার দায়ে মিয়ানমারের কোন সেনাসদস্য,বিজিপি সদস্যকে কারাগারে রাখেনি, বিচারের নামে দন্ডিত করেনব, যা বাংলাদেশী নাগরিকদের ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার করেছে। 
মিয়ানমারের সামরিক সরকার এখনও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার এবং এই সরকারের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আইন  ও রীতি অনুযায়ী দুতাবাস স্থাপনের মাধ্যমে কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের সিংহভাগ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে হলেও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সাথে বাংলাদেশ সরকারের কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নাই।  মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বে এখনও জান্তাবাহিনী থাকলেও আরাকান রাজ্যের বেশীর ভাগ অঞ্চল ও প্রশাসন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে বলে জানা যায়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও তাদের অনুগত রাখাইন সহযোগীদের অত্যাচার নির্যাতনে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১৪লাখের অধিক। আরাকান রাজ্যে এখনও পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রায় ৬লাখ রোহিঙ্গা নিজ জন্মভুমিতে বসবাস করছেন। জান্তা সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দিলেও জোরপূর্বক জরুরী প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করছে। রোহিঙ্গারা বলছেন তাদের সন্তানদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মৃত্যুর মূখে টেলে দিচ্ছে জান্তা বাহিনী। আবার আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা তরুণরা আরাকান আর্মির হয়ে জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বলে জানা যায়। কুটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ করে অপহৃত জেলেদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করা যায়। মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে আন্তর্জাতিক অংগনে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দিয়া সাহায্য করছে চীন। আবার আরাকান আর্মিকে গোপনে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে চীন। 
সর্বশেষ সংবাদে জানা যায় অপহৃত ১০জন বাংলাদেশী জেলে নিজ বাড়ীতে ফিরে এসেছেন। তাদের পরিচয় বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র জেলে ও তারা কোন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য নন তা নিশ্চিত হয়ে আরাকান আর্মি তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়েছেন। তাদের সাথে আরাকান আর্মি কোন ধরনের নির্যাতন বা অসম্মানজনক আচরণ করেনি। জান্তাবাহিনী বা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপি কর্তৃক অপহৃত হলে অবশ্যই নির্যাতন করা হতো, বিচারের নামে শাস্তি দিয়ে কারাগারে রাখা হতো বা মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেওয়া হতো। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা সেই রকম সাক্ষ্য দেয়। মিয়ানমারের বর্বর,নিষ্ঠুর,দয়া—মায়াহীন সামরিক জান্তা বাহিনীর সাথে কেবলমাত্র তুলনা করা যেতে পারে ইসরাইলের ফিলিস্তিনিদের ওপর লাগাতার গণহত্যাকারী নিষ্ঠুরতম দানবতূল্য মানবতাবিরোধী হারামী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বাহিনীকে। বাংলাদেশ বা বাংলাদেশীদের জন্য মিয়ানমারের নিষ্ঠুর জান্তা বাহিনীর চেয়ে আরাকান আর্মি অনেক বেশী নিরাপদ । আরাকান আর্মির সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যতীত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নিজ গ্রামে পৈত্রিক বসতভিটায় ফিরে যেতে উৎসাহিত করা বা প্রত্যাবাসন করা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। সুতরাং নিজেদের স্বার্থে ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের স্বার্থে আমাদের অবশ্যই আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।

লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.